Home মতামত প্রথম পুজো

প্রথম পুজো

by বাংলা টুডে ডেস্ক
৩৯২ views

শ্রেয়সী বিশ্বাস:

ভোর বাজে তখন ৪টা। আজকের দিনে উঠে ঝটপট স্নান সেরে নিয়ে বাড়িতে ফোন করাটাই তো স্বাভাবিক, আর এদিকে ল্যাপটপ এ মহালয়া চালিয়ে দিলাম। দেবীপক্ষের শুভারম্ভ। “মা, প্রণাম নিয়……” বাড়িতে কথা বলে আমি ব্যালকনি তে গিয়ে রেলিং ধরে দাড়ালাম। কই! কুয়াশা দেখা যাচ্ছে না তো, বরংচ কি গরম পড়েছে রে বাবা। ছোটবেলার মজাটাই ছিল আলাদা।

আজকের দিনে স্কুলের ছুটি, সকাল সকাল উঠে স্নান করে ওই ঠান্ডার মধ্যে লেপে আবার জড়িয়ে, বীরেন্দ্র ভদ্র কৃষ্ণের মহালয়া শোনা, “আশ্বিনের শারদপ্রতে, জেগে উঠে আলোকমঞ্জির…” আহাহা, মনে পড়লেই গায়ে শীতকাটা লাগে। তা শোনা হয়ে গেলে, নিচে বাগানে গিয়ে শিউলি ফুল তুলে আনা, তারপর ছোট্টদের কার্টুন শো মহিষাসুর মর্দিনী দেখা। এই দিনটা আমার জন্য খুবই প্রিয়। জানিনা কেন, ঐদিন যেন আকাশে এক আলাদা রং মেতে যায়, কুয়াশার মধ্যে কেমন যেন দেখাযায়, ঐতো মা আসছেন। পুজো হলো বাঙালিদের জন্য এক আলাদা অনুভূতি।

“হেই, ইতনা সুবাহ সুবাহ কয়ু উঠ গয়ে?”
ভেতর থেকে উনি আওয়াজ দিলেন। মা বলেছিলেন, প্রেমে পড়ে অবাঙালি কে বিয়ে করে পস্তাবি। বিয়ের প্রথম বছর, প্রথম পুজো, জানি আমি, ও তো এতটা বুঝবেনা মহালয়ার কি তাৎপর্য্য, কিন্তু অনেক বছর ধরেই আমরা একসঙ্গে আছি, তাই ও এইটুকু তো বোঝে আমার জন্য আজকের দিনটার অনেক দাম।

“কফি?”
মহালয়া হক না শে যাই, আমার জন্য কফি আর নিজের জন্য চা, রোজ সকাল বেলা ওই বানায়। আমি মুচকি হেসে কাপ টা নিয়ে নিলাম, ও ভিতরে চলে গেলো। আজ কলকাতা সহর টাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, কেমন পুজো পুজো গন্ধ হবে, যদিও শাড়ি শাড়ি মানুষের ভীড়, পুজোর বাজার, যতদূর চোখ যায় শুধু হলুদ গাড়ি, কিন্তু তাও, শহরটা কেমন সাজলো, তা না দেখলে বাঙালির ঘুম আসে নাকি ৪ দিন। কিন্তু, এখানে তো কিছুই নেই, একটু পরেই গাড়ির চে চে শুরু হলে বলে, এমনি এমনি কি স্বপ্নের শহর বলে এটাকে। আমাদের ও অফিসের জন্য তৈরি হতে লাগবে, তারপর গাড়ি নিয়েই ওই ভির রাস্তায় চাপা দাও… এইসব ভেবে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।

মহালয়ার গান শেষ হলে দুজন তৈরী হয়ে বাড়ির থেকে বেরোলাম। এপার্টমেন্টের লিফ্ট থেকে অফিসার পুরো রাস্তা আমার গোমড়া মুখ দেখে ও আর কিছু বলতে চাইলো না। এইবার ঠাকুর পুকুরের বাড়িতে নাকি বড়ো প্যান্ডেল লাগিয়ে বারোয়ারি পুজো হচ্ছে, আমার যদিও অতো আত্মীয়দের সাথে দেখা করার কোনো ইচ্ছে নেই, তাও গেলে ভালো হতো। অমনের সাথে সবাইর দেখাও হয়ে যেত, কিন্তু এখানে তো ছুটিই নেই, দুজনে যে ছুটি নেবো, তারও তো কোনো উপায় নেই। ধুরর !!! অফিসে বসে বসেও সারাক্ষন লুচি আর আলুর দম, কষা মাংস, আলু পস্ত, এইসবের কথাই মাথায় ঘুরছিল। কাজে আর মন বসলো না।

আজ মহাষষ্ঠী। অমনের শরীর টা খারাপ করেছে, তাই ও বাড়িতেই রইলো, আমি একাই গাড়ি চালিয়ে এলাম অফিসে। একী অফিসের ৫ তলা তে ওর বিভাগ, র ৭তে আমার। দুপুরের খাবার আমরা প্যায় সবসময় একসাথেই খাই। নাহ! আজ আর ভালো লাগছে না। সারাদিনের কাজ সেরে আজ একটু তাড়াতাড়িই ফিরে এলাম।

“একী!? কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
আমাদের দুজনের কাছেই ঘরের দুটো চাবি আছে, তাই নিজেই ঢুকে আমি অবাক হয়ে জিগেশ করলাম, ট্রলি ব্যাগ একটা প্যাক করা, অমন তৈরী হয়ে বসা। নিজের ফোন খুলে কী যেন মন দিয়ে পরে আমাকে বললো,
“টিকেট তা আমি আনেক আগেই কেটে রেখেছি, আজ রাতকা ফ্লাইট সে আমরা কলকাতা যাচ্ছি!”

গত কয়েকদিনে এই আমার মুখে হাসি ফুটলো!
“আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছো!”
“নহি নহি, জলদি রেডি হো। ওই হ্যাভ টু লিভ!”
ও ফ্লাইট এর টিকেট বের করে দেখালো। এ তো সত্যি সত্যি টিকেট।
“আর অফিসের ছুটি?”
“ইউ ডোন্ট থিঙ্ক, গেট রেডী”

সারপ্রাইজ দিতে ইনি মহান, কিন্তু আজকের টা কিছুতেই ভাবতে পারিনি। যদি জিজ্ঞেস করো আবার উনি কিছু বলবেনা। কলকাতা পৌঁছে বাড়িতে সবাইকে চমকে দিলাম দুজনেই, সবাই খুব খুশি হলো। বাড়িতে এত সাজগোজ দেখে অমন খুবই আশ্চর্য ছিল, উত্তেজনায় আমাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো, “পুজো শেষ হওয়ার পর কারোর বিয়ে আছে নাকি?” ওর সামনে আমার হাসি থামলো না। “দুর্গা পুজো কি জিনিষ, এটা তুমি নিজের চোখে ভালো করে দেখবে এবার, আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবো।” বাড়িতে একদিন পেরোতে না পেরোতেই দেখি ও বাড়ির ছেলেদের সাথে কাজে লেগে গেছে !

পুজোর ফুল আনা, রাত দুপুরে মানুষদের খাবার পরিবেশন করা, এই চমৎকার দেখে আমি অবাক এবং খুশি দুটোই হলাম, এই দুর্গোৎসবের যে কি উদ্যম আর যে কোনো মানুষের মায়ের প্রতি টান এই চারদিনে কতটা বাড়তে পারে টা একে দেখে আর কেউ বুঝুক না বুঝুক, আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম, নাহলে ওর মতো ল্যাধখরের সকাল সকাল উঠে স্নান করতে বয়ে গেছে।

মহাঅষ্টমীর রাত, আজ নানা রকম কম্পিটিশন রয়েছে কমিটির তরফ থেকে, কিন্তু আমার ধুনোচি নাচ টা সবার একটু বেশিই প্রিয়, তো শেটা সবচে শেষে রাখা হলো। সায়ান দা আর শোমু, আমার ছোট ভাই গিয়ে পাড়াতে পোস্টের বিতরণ করে এসেছিল সকলেই, ভীর বাড়ছে দেখে দুজনেই খুব খুশি হল, অমনকেও কতদিন পর এত খুশি দেখলাম, নাহলে সারাদিন কাজের চাপে কিছুই করে না। সব মাসী পিসি কাকু কাকিমনিদের নাচ শেষ হওয়ার পর, যেই আমার পালা এলো, ধুপ্তি হাতে নিয়েই দেখি পাশে অমন ইতোমধ্যে আরেকটা ধূপটি নিয়ে রেডী।
“তুমি এটা নিয়ে নাচবে?”
“হা, কয়ু, ইয়াহা সব লোগ নিজের বউএর সাথে ডান্স কিয়া হ্যা, মে ভি করুঙ্গা, তুম করো, আই উইল রিপিট”
চোখে শুধু ধুপ্তির ধুয়ার জল নয়, সত্যি সত্যি ওইদিন মায়ের চোখে দেখে জল এসে গেলো। সবাই অমনকে উৎসাহ দিল, আর আমার জন্যও ওই সময়টা, বুকের ভেতর স্মৃতি হয়ে রইলো।
নবমীর রাত কেটেগেলেই, সবার মন্য করুন শুরু ধরলো, শুরু হলো মিষ্টিমুখ, ও শিদুরখেলার মাধ্যমে বিজয়া। এক এক করে সরস্বতী, লক্ষ্মী, কার্তিক আর গণেশ কে ট্রাকে তুলে নেওয়া হলো। যেই নাকি দুর্গার প্রতিমা তোলা হবে, দেখি অমন কমিটির টি-শির্ট পরে, এবং আমাকে একটা ধরিয়ে দিয়ে, মূর্তি তুলতে গেলো।
“আরে তুমি পারবেনা, ছেরেদাও, ওরা করে নেবে”
“তুম টি-শির্ট পরে ট্রাক মে যাও, আমি আসছি”
“তুমি বিসর্জনে যাবে? তুমি জানো ওখানে কেমন ভের হয়? এই গরমে তোমার শরীর খারাপ করলে কি হবে বুঝতে পারছো?”
আমার কথা কানেই নিল না, প্রতিমা ট্রাকে তুলে, আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “মা আছেন, মেরা কুছ নাহী হোগা।”

এই কথা শুনে আমি হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। পুজোর নেশায় ও এতটা মিশে যাবে, তা ঠিক মানতে পারছিলাম না।
কলকাতার ভের ও আগে দেখেনি, আর বিসর্জনের দিন তো শাড়ি শাড়ি লোকের মেলা রাস্তায়, কিন্তু তাও ও পুজোর রঙে এমন ভাবে মিশে গেছিলো যে সারাটা রাস্তা, মায়ের মূর্তির পাশে দাড়িয়ে, দুগ্গা মাই কি জয় করতে করতে দুর্গা বিসর্জন করলো। আবার বিসর্জন শেষ হলে, বড়দের পায়ে ছুয়ে শুভোবিজোয়াও বললো। আমি শুধু দেখতেই রয়ে গেলাম। বুঝতে একটু দেরি হলো বৈকি যে কেন ওইদিন ও এত মন দিয়ে ল্যাপটপে মহালয়া শুনছিল।

এই কোয়েকদিন বেশ ভালই কাটলো। এখনও মুম্বাইয়ের ওই ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসে ল্যাপটপে প্রথম পুজোর ছবিগুলো দেখি, মুখে হাসি ফুটে যায়, কিন্তু কেমন চোখ বন্ধ করতেই উরে গেলো। এইটাই তো হয় প্রতি বছর, মা আসেন র দেখতে দেখতেই চলে যান। আর শান্ত হয়ে যায় এক বছরের জন্য ওই শুরকণ্ঠ “বাজলো তোমার আলোর বেনু…”

মাকে দেখার লোভে, তৃষ্ণায় আর উৎসাহতেই তো সবাই বলে “আসছে বছর আবার হবে।”

আরো পড়ুন

সম্পাদক: শুভ্র মেহেদী

মোবাইল: ০১৯৮৫৮২৭৮৩০
ই-মেইল: jamalpur.banglatoday.2022@gmail.com

মিডিয়া ক্যাম্পাস, পৌরসুপার মার্কেট (২য় তলা), রানীগঞ্জ বাজার, তমালতলা, জামালপুর।

Developed by Media Text Communications