Home মতামত এসো বঙ্গবন্ধুকে জানি

এসো বঙ্গবন্ধুকে জানি

by বাংলা টুডে ডেস্ক
২৫৪ views


মো. শাহ্ জামাল:
বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ-বাংলাদেশকে নিয়ে বিদেশেও গবেষণা চলছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি পৃথিবীর ১৪টি ভাষায় রূপান্তর হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে ৭ মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার বিপ্লবের ডাক।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন-দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদার। মাতার নাম সায়েরা খাতুন। শেখ মুজিবের দাদার নাম শেখ আব্দুল হামিদ। নানা শেখ আব্দুল মজিদ শেখ মুজিবকে খোকা নামে ডাকতেন। শেখ মুুজিববুর রহমানের পূর্ব পুরুষ ইসলাম ধর্মের প্রচারক এবং পীর ছিলেন। যাদেরকে বলা হতো শায়েখ। সেই শায়েখ বংশ থেকেই শেখ বংশের উদ্ভবের ইতিহাস পাওয়া যায়।

শেখ মুজিবের পূর্ব পুরুষরা হলেন-শেখ বোরহান উদ্দিন। তাঁর পূর্বপুরুষ শেখ আব্দুল আউয়াল ছিলেন- ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ) এর সহচর। ইরাক থেকে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার কাজে আগমন করেন। শেখ আব্দুল আউয়ালের পুত্র শেখ জহির উদ্দিন কলকাতায় ব্যবসা করতেন। শেখ জহীর উদ্দিনের পুত্র শেখ জান মাহমুদ। তাঁর পুত্র শেখ বোরহান উদ্দিন। শেখ বোরহান উদ্দিন টুঙ্গিপাড়ায় কাজি পরিবারের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। শেখ বোরহান উদ্দিনের নাতিন হলেন শেখ আব্দুল হামিদ। এই আব্দুল হামিদই হলেন শেখ মুজিবুর রহমানের দাদা।

৭ বছর বয়সে শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৪ বছর বয়সে চোখের অপারেশনের কারণে ৪ বছর পড়াশোনা স্থগিত থাকে। গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুল পাশের পর ১৯৪১ সালে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। ওই বছর তিনি ফরিদপুরে জেলা ছাত্র লীগের সম্মেলনের আয়োজন করেন। কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁসহ অনেকেই এই সম্মেলনে যোগদান করেন।

১৮ বছর বয়সে বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে বিয়ে করেন। তাঁদের ঘরে দুই মেয়ে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল জন্ম নেয়। বাল্যকালেই শেখ মুজিব উদার-জনহিতকর কাজে মনোযোগি ছিলেন। দুর্ভিক্ষের সময় নিজের ঘরের খাদ্য-পানীয় অসহায় মানুষের মাঝে বিতরণ করতেন। এন্ট্রান্স পাশের পর শেখ মুজিব কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মাওলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন। কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৪ সালে ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪৭ সালে বিএ পাশ করেন।

ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলের ২৪ নং রুমে তিনি থাকতেন। ১৯৯৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২৩ ও ২৪ নং কক্ষদ্বয় একত্র করে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ নির্মাণ করে। ২০১১ সালে এই কক্ষের সামনে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করেছে।
পাক-ভারত বিভক্তের পর ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

ওই বছরই তিনি মুসলিম ছাত্র লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারিদের ধর্মঘটের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন। এ জন্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে তাঁকে বহিস্কার করে। ২০২০ সালের ১৪ আগস্ট বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে।

১৯৩৯ সালে স্কুল জীবনেই তিনি গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং মহকুমা মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। পরের বছর সমগ্র ভারতবর্ষের ছাত্র ফেডারেশনে যুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগদান করেন।

১৯৪৪ সালে কুষ্টিয়ায় নিখিল বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্র লীগের সম্মেলনে যোগদান করেন। ওই বছরই তিনি ফরিদপুরবাসির কল্যাণে কোলকাতাস্থ ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হন।

ভারতবর্ষের অন্যতম রাজনৈতিক দল ছিল বেঙ্গল মুসলিম লীগ। তখন মুসলমানদের নেতা হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর খুব প্রভাব ছিল। তখন থেকেই একটি মুসলিম রাষ্ট্র গড়ার তৎপরতা জোরদার হচ্ছিল। পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগের কাউন্সিলর মনোনীত হন।

তাঁর নেতৃত্বের দক্ষতার জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আস্থাভাজন হন। আন্দোলনের ফসল হিসেবে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারতবর্ষ থেকে পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হয়। সেই হিসেবে পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনেও শেখ মুজিবের অবদানের ইতিহাস অস্বীকার করা যায় না। পরের বছর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শেখ মুজিব শীর্ষ ছাত্র নেতায় পরিণত হন। পাক-ভারত পৃথকের পর হিন্দু-মুসলিম প্রতিহতের জন্য বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখেন।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন একজন সাহসী, আদর্শের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। যার প্রমান মেলে গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুলের সংবর্ধনা সভায় আসেন বাঙ্গলার বাঘ খ্যাত একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সভাশেষে ফেরার পথে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে গতিরোধ করেন।

মিশন স্কুলের জরাজীর্ণ ছাত্রাবাস মেরামতের জন্য টাকা চাই। চাহিদা মাফিক ১২শ টাকা মেরামতের জন্য প্রদান করেন হক সাহেব। মুজিবের এই সাহসীকতার তারিফও করেন তিনি।

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান পৃথক হবার পর মাত্র ৪ মাসের ব্যবধানে দাপ্তরিক ভাষা সিলেকশন নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। ঢাকা থেকে পাকিস্তানে প্রেরিত গোয়েন্দাদের একটি প্রতিবেদন বাইরে জানাজানি হয়। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু লোক উর্দ্দু ভাষাকে মানার পক্ষে। কিছু লোক মেনে নিচ্ছে না। বিশেষ করে ঢাকাবাসি।

কিছু অফিস, জনৈক ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে সংবাদপত্রের মালিকদের সাথে বৈঠক করছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়। সেই গোপন সংবাদটি ৯ ডিসেম্বর কোলকাতা থেকে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। খবরে মুসলমানদের মধ্যে বড় ধরণের দাঙ্গার আশংকা করা হয়।

ওদিকে সরকারের মদদে পাকিস্তানপন্থি কিছু লোক উর্দ্দু ভাষার পক্ষে মিছিল-সমাবেশের আয়োজন করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনতা এর বিরোধীতা করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে তারাও মিছিল-মিটিং-সমাবেশ অব্যাহত রাখেন। ১২ ডিসেম্বর/৪৭ রাষ্ট্রভাষার বাংলার দাবিতে ঢাকাতে প্রথম হরতাল পালিত হয়। হরতাল পালনকারিদের উপর নির্যাতন চালানো হয়। ১৩ ডিসেম্বর কোলকাতার যুগান্তরে এই খবরটি প্রকাশিত হয়।

১৩ ডিসেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকা ও ১৪ ডিসেম্বর অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশ, ১২ ডিসেম্বর হরতালের পরদিন থেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও জনতার মাঝে আন্দোলন চাঙ্গা হয়। ছাত্র-জনতার হরতালের মধ্যে সরকারি অফিস-সচিবালয় এমনকি সুপ্রিম কোর্টের কর্মকান্ডও বন্ধ থাকে। ওই দিন কোন দোকানপাটও খোলেনি।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী ডন পত্রিকায় পাকসরকারের পক্ষে বলা হলেও, খবরটি সম্পূর্ণ বাংলাভাষিদের পক্ষে চলে যায়। খবরে প্রকাশ, ১৫ দিনের কার্ফিউ জারি করেছে। ম্যাজিস্ট্রেট-পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আন্দোলনকারিদের খোজে বের করা হবে।

বিভিন্ন স্থানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণটি বাংলা-উর্দ্দু ভাষায় প্রচার করেও কোন কাজে আসছে না। সরকারের পক্ষে ঢাকার খাজা হাবিবুল্লাহর আহবানে সভাটিও করা যায়নি। ১৭ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশ, হামলার প্রতিবাদে হরতালের দিন ঢাকার জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক নুরুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়।

এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রণিত আওয়ামী লীগের উত্থান শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিন।
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ইটিভির প্রতিবেদনে প্রকাশ, ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন গণপরিষদে ভাষণে উর্দ্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে।

বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে এই ভাষণের প্রতিবাদ করেন। এই ভাষণটি পূর্ব পাকিস্তানে গণবিষ্ফোরণে পরিণত হয়। ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। মায়ের ভাষা বাংলা ভাষাকে কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনতা রুখে দাড়ায়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ১১ মার্চ/১৯৪৮ হরতাল পালনকালে শেখ মুজিবকে সচিবালয়ের সামনে থেকে বন্দি করা হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের দাবি মানার আশ^াসের শর্তে সংগ্রাম পরিষদের সাথে খাজা নাজিম উদ্দিন সরকারের চুক্তি হয়। ১৫ মার্চ শেখ মুজিব মুক্তি পান। পরদিন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আমতলায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র-জনসভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিব। ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হরতাল পালনের ডাক দেন।

যার খবরা খবর তৎকালীন গণমাধ্যম এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনেও উল্লেখ আছে। দীর্ঘ আন্দোলনে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ বহু লোকের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা মাতৃভাষার স্বীকৃতি পায়। এই ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় আব্দুল মতিনকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করে।

প্রথম আলো ২১ ফেব্রুয়ারি/২০১৮ সংখ্যায় ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাতকে মুল্যায়ন করে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এটিকে স্বাধীনতা-উত্তর পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সফল হরতাল হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই হরতালের মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলনের দাবি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে গোটা দেশের মানুষের সম্পৃক্ততা এবং আন্দোলনকারিদের প্রতি সহানুভূতি দ’ুটোই হাসিল হয়।

১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি আগরতলা মামলায় গ্রেপ্তার হন। মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজনীতিবিদসহ মোট ৩৫ জনকে আসামী করে পাকিস্তান সরকার। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তারে বাঙ্গালির স্বাধীকার আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতি মানুষের অধিকার আন্দোলনের দায়ে তিনি গ্রেপ্তার হন। সকালে আটক-বিকেলে মুক্তি, রাতে আটক-কিছুদিন পর মুক্তি এভাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ তিনি প্রায় ১ যুগ কারাবরণ করেন।

১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবের ৬ দফাসহ ১১ দফার দাবির প্রেক্ষিতে দেশের পরিস্থিতি নতুন করে মোড় নেয়। দাবি আদায়ের জন্য গড়ে তোলা হয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পাকসরকার রাষ্ট্রদ্রোহির অভিযোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত বঙ্গবন্ধুর পাহারাদার মোখলেসুর রহমান মিলিটারি (সৈনিক নং-৬২৫৬৯১)। তার সাথে আমার সরাসরি কথা হয়।

মোখলেস মিলিটারি পাক-ভারত যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য পুরস্কারও অর্জন করেছেন। তিনি বলেন-কোর্টে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু জোরগলায় বলে ছিলেন-আমি এই কোর্ট মানি না। এই কোর্টকে লাথি মারি। আমাকে মিথ্যা-সাজানো মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। আমি নিজের জন্য কিছুই করিনি। যা করেছি, বাঙ্গালির স্বার্থেই করেছি। এটা অপরাধ হতে পারে না। ব্রিটিশ আইনজীবী ও পার্লামেন্ট মেম্বার টমাস উইলিয়াম আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পর্যবেক্ষনে এসে এই মামলাকে অবৈধ ঘোষণা করেন।

মোখলেস মিলিটারি আরো বলেন-যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার আমাকেসহ ৯শ’ বাঙ্গালিকে আটকে দেয়। দেশ স্বাধীনের পরে বঙ্গবন্ধুর সহায়তায় পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসি। মোখলেসু রহমান হলেন-বিএনপি’র সাবেক মহাসচিব, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ব্যরিস্টার আ: সালাম তালুকদার এবং বঙ্গবন্ধুর সহচর এডভোকেট মতিউর রহমান তালুকদারের ভাগ্নি জামাই। অর্থাৎ সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান এমপি’র ফুফাতো ভগ্নিপতি।

১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ২৩ ফ্রেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা দেয়া হয়। ওইদিন শেখ মুজিবুর রহমানকে তৎকালীন ডাকসু ও ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। ১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা গণদাবি এবং ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবি উত্থাপন করেন। পাকসরকার বঙ্গবন্ধুর এই অনড় দাবি প্রত্যাখান করে।

১৩ মার্চ তিনি গোলটেবিল বৈঠক ত্যাগ করে পরদিন ঢাকায় ফিরেন। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করে। ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানকে গণমানুষের পক্ষে বাংলাদেশ নামকরণের ঘোষণা করেন।

১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরুঙ্কুশ বিজয়ী হলেও; পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করে উল্টো ষড়যন্ত্র করতে থাকে। বাঙ্গালির উপর দমন-পীড়ন শুরু করে। এ নিয়ে গোটাদেশেই ক্ষোভের জোয়ার চলছিল।
১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে। শেখ মুজিব ৩ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন।

২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারসহ পাকসরকার পূর্ব বাংলার মানুষের উপর গণহত্যা চালায়। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বিখ্যাত সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গ নিউ ইয়র্ক টাইমস এ বঙবন্ধুর সাক্ষাৎকারে তার উপর নির্যাতনের কথা ওঠে আসে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গ্রেপ্তারের সময় বঙ্গবন্ধুর ক্রন্দনরত স্ত্রী ও সন্তানদের শেষবারের মতো তিনি বিদায় জানালেন।

হয়তো আর ফিরে আসবেন না। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে জোর করে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনল। বন্দুকের বাট দিয়ে কয়েক বার গুঁতোও দেওয়া হলো তাঁকে।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনে কর্মরত পুলিশ সদস্য আব্দুর রশিদ খান জানান-২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল ভেসপা গাড়িযোগে পাকবাহিনীরা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমন করতে পারে বলে সতর্ক করে যান। এর কিছুক্ষণ পরেই পাকবাহিনীরা পুলিশ লাইনে আগুনের গোলাবর্ষণ করে। এতে বহু লোক হতাহত হন। আব্দুর রশিদ খান পাকবাহিনীদের হাতে আটক হলে, তাকে পিটিয়ে মেরুদন্ডের হাড্ডি ভেঙ্গে দেয়।

শেখ মুজিব গ্রেপ্তারের পর ২৭ মার্চ/৭১ চট্রগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন-পূর্ব বাংলার রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান। তখন পুরোদেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। টানা ৯ মাস যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়া হয়। ১২ জানুয়ারি তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপদগামী সেনাদের হাতে সপরিবারে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ওই বছর শেখ হাসিনা ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষার্থী ছিলেন। ওই সময় শেখ হাসিনা স্বামী ড. ওয়াজেদের সাথে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তখন জার্মানীতে যান। ওয়াজেদের ছুটির কারণে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অবস্থান নিয়েছিলেন-ব্রাসেলসের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায়। পরদিন তাদের জার্মানিতে যাবার কথা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সানাউল হক ভারতে মিশন প্রধান ছিলেন।

দেশ স্বাধীনের পরে বঙ্গবন্ধু তাঁকে রাষ্ট্রদূত মনোনিত করেন। ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল বিবিসির প্রতিবেদনে প্রকাশ, রাষ্ট্রদূত সানাউল হক যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার টেলিফোন পেলেন। সেনাবিদ্রোহে হাসিনা-রেহানার পিতাকে হত্যার কথা জানালেন। তাদেরকে প্যারিসে না গিয়ে জার্মানে যেতে বলেন। সাথে সাথে শোকার্ত দুই বোনকে তার বাসা থেকে একরকম জোর করেই বের হতে বলেন। তাদেরকে একটি গাড়ি দিতেও অপারগতা প্রকাশ করেন।

শেখ হাসিনার দুই শিশু সন্তান ও বোন শেখ রেহানা জার্মানীর বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর কাছে গেলেন। যুগোস্লাভিয়ার সফরে আসা তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডক্টর কামাল হোসেনও সেখানে পৌঁছেন। তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে ওই মুহুর্তে জার্মান রেডিও ডয়েচেভেলে, রয়টারসহ বেশ ক’জন সাংবাদিকরাও সেখানে হাজির হন। হাসিনা-রেহানা এতটাই শোকার্ত-এতিম-অসহায় অবস্থায় মানষিকভাবে ভেঙ্গে ও মুষড়ে পড়েন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও কোন মন্তব্য নিতে পারেনি। ডক্টর কামালও কোন মন্তব্য করেননি। তড়িগড়ি করে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর কাছে হাসিনা-রেহানা থাকার কথাটি নিশ্চিত করলেন। তারা কোথায় থাকবেন, সিদ্বান্তহীনে ছিলেন। ইতোমধ্যেই যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটু ফোনে হাসিনা-রেহানা ও ড. ওয়াজেদের খবর নেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মহামতি ইন্দরাগান্ধী দুই বোনকে তার দেশে আশ্রয় দেন। ২৪ আগস্ট/৭৫ ইন্ডিয়ার একিটি বিমানযোগে ভারতে আসেন। ১৫ আগস্টে কি হয়েছিল, ইন্দিরাগান্ধী জিজ্ঞাসার সাথেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সিরাজ উদ্দিন আহমেদ রচিত শেখ হাসিনার জীবনী গ্রান্থে উল্লেখ, ইন্দিরাগান্ধী তখন শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুছে দেন। শান্তনা দিতে বলেন তোমার ছেলেটাকে পিতা এবং মেয়েটাকে মা হিসেবে ডাকবে।

যা হবার হয়েই গেছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেবার নয়। পরের বছর বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি শামসুর রহমান সস্ত্রীক হাসিনা-রেহানাকে দেখতে গেলে কান্নার রোল পড়ে যায়। ওই বছরই ২৪ জুলাই লন্ডন প্রবাসি ড. সফিক সিদ্দিকের সাথে শেখ রেহানার বিয়ে সম্পন্ন হলেও; হাসিনা-ওয়াজেদ কেও বিয়েতে থাকতে পারেননি। ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস অফিসার পিকে সেন এবং সত্য ঘোষ তাদের নিরাপত্ত্বার কাজে ছায়া হিসেবে ছিলেন।

২০১৪ সালের ১৫ আগস্ট ডেইলি স্টারে বঙ্গবন্ধুজ ডটার্স শীর্ষক প্রতিবেদনে রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের ছেলে নোমান রশিদ চৌধুরীর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে উল্লেখ, তৎকালীন পশ্চিম জার্মানের ভারতীয় দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ওয়াইকে পুরীর সাথে যোগাযোগ করেন-তার বাবা সানাউল হক। হাসিনা-রেহানাকে ভারতে আশ্রয় দেয়ার বিষয়ে তাদের মধ্যে কথোপকথন হয়। একপর্যায়ে ওয়াইকে পুরী সানাউল হকের দপ্তরে এসে বলেন, ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় লংলি প্রসেস।

তাকে সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধীর বিশ^স্ত পরামর্শক ডিপি ধর এবং পিএন হাক্সরের কাছে ফোন করেন। তখন তারা দু’জনই দেশের বাইরে ছিলেন। সবশেষে সরাসরি ইন্দিরাগান্ধীর কাছে ফোন করেন-সানাউল হক। ফোন নম্বরটাও দেন মি. পুরী। ফোনে বিস্তারিত শোনার পরপরই ইন্দিরাগান্ধী তাৎক্ষণিকভাবেই হাসিনা-রেহানাকে আশ্রয় দিতে সম্মত হলেন।

১৯৭৭ সালে ভারতের নির্বাচনে ইন্দিরাগান্ধী হেরে গেলেন। শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ প্রণিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ, নতুন প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাইয়ের অবজ্ঞা-অবহেলায় পড়েন তারা। সিরাজ উদ্দিনের লেখা বইয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে বিবিসিতে আরো প্রকাশ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই শেখ হাসিনার ফ্ল্যাডের বিদ্যুৎ বিল বন্ধ এমনকি গাড়ি ব্যবহারও প্রত্যাতার করে নিলেন।

ড. ওয়াজেদের ৩ বছরের ফেলোশীপের আবেদনের প্রতিউত্তর ৩ মাসেও আসেনি। তবে ১ বছরের ফেলোশীপ অনুমোদন দেয়া হয়। সবমিলে শেখ হাসিনার উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়, যাতে তিনি স্বেচ্ছায় কোথাও চলে যান। ১৯৮০ সালে ইন্দিরাগান্ধী ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তবে ইন্দ্রিরাগান্ধী সরকারের মন্ত্রী প্রণব মুখার্জি শেখ হাসিনার সাথে যোগাযোগ রাখতেন। যার প্রমান পাওয়া যায়, ড্রামাটিক ডিকেট গ্রন্থে।

বইতে প্রণব মুখার্জির স্মৃতিচারণে বলা হয়, শেখ হাসিনার সন্তানদেরকে প্রায়ই বাসায় নিয়ে নিজের সন্তানদের সাথে খেলতে দিতেন। পিকনিকেও পাঠাতেন।

১৯৮১ সালের ১৭ মে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ এবং কোরবান আলীর সাথে শেখ হাসিনার জন্মভূমি এই বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে ওই দিন ঢাকা বিমানবন্দরে ১৫ লক্ষাধিক লোক জমায়েত হন।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম অপরাধ। হত্যাকান্ডটি কারবালার ন্যায় স্মরণীয় এবং নিন্দনীয়। ৫৭০ সাবানে গোসল দিয়ে তাকে মাত্র কয়েকজনে জানাজা পড়ার পর কবরস্ত করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের অনেকেই আজীবন ৫৭০ সাবান দিয়ে করেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবরে ধিক্কার জানিয়ে নোবেল বিজয়ী ইউলি ব্রান্ট বলেছিলেন-বাঙ্গালিদের আর বিশ^াস করা যায় না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পিছে আন্তর্জাতিক শক্তিও ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারিদের পুরস্কার স্বরূপ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা-রাষ্ট্রদূত পর্যন্তও বানানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য খন্দকার মোস্তাক বাহিনীর তৎকালীন সেনা অফিসারকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

অনেকেরই ফাঁসি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারিদের প্রকাশ্যে বিচার দাবি করায় সেনাকর্মকর্তা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক খালেদ মোশাররফকেও হত্যা করা হয়। ৭ নভেম্বর/২০১৮ বিবিসির এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, কর্নেল কে এন হুদা, ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার, খালেদ মোশারফকে কার নির্দেশে এবং কেন হত্যা করা হয়েছিল এখনো তার কোন তদন্ত হয়নি। ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে খালেদ মোশাররফের মেয়ে মেহজাবিন বেবি এমপি তাঁর বাবাকে হত্যাকারিদের বিচার দাবি করেন।

যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় বঙ্গবন্ধুর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল প্রখর। ১৯৭৩ সালে তিনি আলজেরিয়ায় জোট নিরপেক্ষ ন্যাম সম্মেলনে গিয়ে বঙ্গবন্ধু দেখলেন; পরাশক্তির দেশগুলো তাদের বাহাদুরি নিয়ে যার যার অবস্থানে আছে। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর এটিই প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান। তিনি কোন দিকে ঝুঁকবেন! মুহুর্তটি অগ্নিপরিক্ষার।

তিনি কৌশলে তার অবস্থান পরিস্কার করে বলেন-বিশ^ এখন দুই শিবিরে বিভক্ত। শোষক-আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। ন্যাম সম্মেলনের খবরাখবর ফলাও করে প্রচারিত হয় বিশ^মিডিয়ায়। এরমধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই আধা পৃষ্টাজুড়ে খবর প্রকাশ করে। বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী তৎকালীন রেডিও বাংলাদেশের মহাপরিচালক, দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথিতযশা সাংবাদিক এম.আর. আখতার মুকুলের লেখা ঙ্গবন্ধুর রক্ত লাল বইতে আরো বিস্তারিত উল্লেখ আছে।

মাই গোল্ডেন বেঙ্গল গ্রন্থ এবং ২০২১ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদনে প্রকাশ, ন্যাম সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধুর সাথে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রোর পরিচয় ঘটে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে পিঠ চাপড়ে ধরে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে অবিহিত করেছেন।

ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছেন-I have not seen the Himalayes. But I have seen shaikh mojib. In personality and incourage, this man is the Himalayes. I have thus head the experience of I witnesing the Himalayes. অর্থাৎ আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যাক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য। আর আমি এভাবেই হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে শত্রু-মিত্র চিনে-জেনে পথ চলার পরামর্শ দেন।

বঙ্গবন্ধু কোন মাদক স্পর্শ করেননি। যার প্রমান পাওয়া যায় ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট ডিবিসির প্রতিবেদনে। জোট নিরপেক্ষ ন্যাম সম্মেলনে যান। বঙ্গবন্ধুর সামনে মদের জার দেখে রাগান্বিত হন। বঙ্গবন্ধুকে ধর্মীয় অনুশাসনে দেখে সেবিকারা হতচকিত হন। ২০০৪ সালের বিবিসির শ্রোতা জরিপে উঠে আসে বঙ্গবন্ধু সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি হিসেবে।

বঙ্গবন্ধু একজন উদার-বিচক্ষণ এবং অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব। ২০১৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের ৭১ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিবিসির প্রতিবেদনে এই কথাটির সত্যতা নিরুপন করা যায়। ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক এবং বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকলেও তিনি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনোনিত হন।

১৯৫২ সালে শামসুল হক অসুস্থ হলে শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। অসাম্প্রদায়িত চেতনায় ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামে দলের নাম পরিবর্তন হয়। ফলে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের লোকেরা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হবার সুযোগ পান।

১৯৮৭ সালের বিজয় সংখ্যা সাপ্তাহিক বিচিত্রার আরেকটি প্রতিবেদনে প্রকাশ, ১৯৫৮ সালে ময়মনসিংহ থেকে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন গঠিত হয়। এটিই পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামি কোন প্রথম রাজনৈতিক দল। আবদুর রহমান সিদ্দিকী, এ.আর. এম. সাঈদ ও খন্দকার ফাজলুর রহমান ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। ফ্রন্টের গোপন বৈঠক হতো রাতের আধারে ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝখানে।

লিবারেশন ফ্রন্টের সেক্রেটারি আবদুর রহমান সিদ্দিকী পূর্ব সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য সাহায্য পেতে ভারতের প্রেসিডেন্ট জওহর লাল নেহেরুসহ সুরেন ঘোষের সাথেও দেখা করেন। ফ্রন্টের ব্যানারে লিফলেট-পোস্টার এবং সংগ্রামী বাংলা নামে একটি পত্রিকাও বের করে। যা পাকিস্তান দলিল এবং জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ফ্রন্টের সেক্রেটারি আবদুর রহমান সিদ্দিকী পল্টন থেকে গ্রেপ্তার হন। সিদ্দিকী নেতাদের বলেছিলেন-ফ্রন্টের দুর্দিনে যেন বঙ্গবন্ধুর সাথে যোগাযোগ করা হয়।

কথামত তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী গিয়াস উদ্দিনের ছেলে নূর উদ্দিন তারা মিয়ার নেতৃত্বে ফ্রন্টের কয়েকজন আলফা ইন্সুরেন্সে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু তখন আলফা ইন্স্যুরেন্সে চাকরি করতেন। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে কিছু টাকা দিয়ে বলেন-এখন রাজনীতি নিষিদ্ধ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তখন মাঠে নামবো। আমি গণতন্ত্রের বিশ^াসী। এখন তোমরা চলে যাও।

গ্রেপ্তারকৃত সিদ্দিকীকে মুক্ত করার জন্য সোহরাওয়াদী, ফজলুল হকসহ অনেকের সাথেই যোগাযোগ করছি। তোমরা গ্রেপ্তার হলে প্রাণে বাঁচাবে না। সাবধানে থেকো। এ কথা শোনে সিরাজ শিকদার দল থেকে চলে যান। লিবারেশন ফ্রন্টের প্রধান গ্রেপ্তারের পর অন্যান্য নেতারাও ঝিমিয়ে পড়েন। অবশেষে দলের বিলুপ্তি ঘটে। ওদিকে সিরাজ শিকদার সর্বহারা দল গঠন করেন। স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে বহুবার কারাবরণ করেন। জীবনে তিনি ১ যুগ কারাবরণ করেন।

বাংলার ইতিহাসে স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু এবং আবদুর রহমান সিদ্দিকীর ন্যায় সর্বোচ্চ কারাবরণের কথা সচরাচর শোনা যায় না। লিবারেশন দলের সদস্য আলী আসাদ কালা খোকা আজো নিখোঁজই আছেন। আবদুর রহমান সিদ্দিকী, আলী আসাদ ও লিবারেশন ফ্রন্ট সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। ২৯ মার্চ’ ২০১৭ দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় সাংবাদিক-গবেষক আফসান চৌধুরীর দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

শেষকথা: কৃতজ্ঞতা চিত্তে স্মরণ করতে হয়, বাংলার স্থপতি-জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ঘুমিয়ে আছো বঙ্গবন্ধ/টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে/তোমায় খুব মনে পড়ে/আজি রাজপথে হাটিতে ॥ করেছো কতো সংগ্রাম/স্বাধীন বাংলার জন্য/তুমি বিনে সোনার বাংলা শুন্য।
– লেখক-ইত্তেফাক সংবাদদাতা ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি-মেলান্দহ রিপোর্টার্স ইউনিটি, জামালপুর। ০১৯১২১৮৫০৬২।

আরো পড়ুন

সম্পাদক: শুভ্র মেহেদী

মোবাইল: ০১৯৮৫৮২৭৮৩০
ই-মেইল: jamalpur.banglatoday.2022@gmail.com

মিডিয়া ক্যাম্পাস, পৌরসুপার মার্কেট (২য় তলা), রানীগঞ্জ বাজার, তমালতলা, জামালপুর।

Developed by Media Text Communications